প্রকাশিত: ১৯/০৪/২০১৮ ৭:৪১ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৪:০০ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::

রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো অনুকূল ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের নিপীড়নকারীদের বিচারে মিয়ানমারকে তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত সোমবার রাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা এক প্রতিবেদনে তিনি এ তাগিদ দেন।

ওই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি কালের কণ্ঠও সংগ্রহ করেছে। প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা যায়, জাতিসংঘ মহাসচিব মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইন শেখাতে ওই দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া মিয়ানমারে সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে চিকিৎসা, মনোচিকিৎসা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারীদের অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে সু চির সরকারকে জাতিসংঘ মহাসচিব তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত নিপীড়নের বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন, বিশেষ দূত ও মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে কাজ করার সুযোগ দিতেও তিনি মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব কেবল রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে তাদের বাসভূমিতে ফিরে যাওয়াই নয়, সেখানে ফিরে যাওয়ার পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নারী ও কন্যাশিশুসহ সংখ্যালঘু সব গোষ্ঠীর সমান অধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তিনি তাঁর মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির দপ্তরের সঙ্গে যৌথ ইশতেহারে সম্মত হতেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রহণ করায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেছেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী—উভয়ের চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করেছেন।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, যেকোনো প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গারা যেখান থেকে এসেছে সেখানে বা তাদের প্রত্যাশিত স্থানে পাঠাতে হবে। এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তাদের অবহিত করে সম্মতির ভিত্তিতেই প্রত্যাবাসন হতে হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—উভয় পক্ষকেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) সম্পৃক্ত করার এবং রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

দায়িত্ব এখন মিয়ানমার ও নিরাপত্তা পরিষদের : এর আগে মানবাধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’, ‘গণহত্যা’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত সোমবার নিরাপত্তা পরিষদে লিখিতভাবে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন, সেখানেও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যৌন নির্যাতন, নিপীড়নসহ সুনির্দিষ্টভাবে তাদের দেশছাড়া করতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ এনেছেন। বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র সংঘাতের মতো পরিস্থিতিতে ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন সহিংসতা সংঘটন বা এর জন্য সম্ভাব্য দায়ীদের বিশ্বাসযোগ্য তালিকায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রায় সাত লাখ বেসামরিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। এই মানবিক সংকট সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসাকর্মী ও সেবাপ্রদানকারীদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসামরিক ওই রোহিঙ্গাদের অনেকেই বর্বর যৌন নির্যাতনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত বহন করছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব লিখেছেন, সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান জন্মহারকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে তা নির্মূল করতে অভিযানের নামে নারী ও শিশু বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের হত্যা, ধর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা।

জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা অভিযানের নামে মিয়ানমার বাহিনীর যৌন নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ জাতিসংঘ যাচাই করেছে। গত বছরের ৪ মে বুথিডংয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী পুলিশ অভিযানের নামে সাতজন রোহিঙ্গা নারীকে এবং ৫ মে ৩২ জন রোহিঙ্গা নারী ও একটি কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করে। গত বছর জানুয়ারি মাসে মিয়ানমারের সেনারা মংডুতে ৩০টি রোহিঙ্গা কন্যাশিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন চালায়। প্রায় একই সময়ে মিয়ানমারের সেনারা মংডুতে ১৬ বছরের একটি কন্যাশিশু ও তার ২০ বছর বয়সী বোনকে নিরাপত্তা অভিযানের সময় ধর্ষণ করে। ওই অঞ্চল সফরকারী সাংবাদিকদের কাছে ওই কন্যাশিশু বিষয়টি জানালে তাকে গ্রেপ্তার করে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব লিখেছেন, গত ৩০ আগস্ট বুথিডংয়ের মংনু গ্রামে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ ও আটক করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ও কন্যাশিশুরা জোরপূর্বক বিয়ে, যৌন নিপীড়ন ও পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে আগামী ২৯ ও ৩০ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে। ওই দলটির মিয়ানমার সফরেরও কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই সফরের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো উদ্যোগ নেবে বলে তাঁরা আশা করছেন। বিশেষ করে ওই সফরের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এই ইস্যুতে একটি জোরালো ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাব তাঁরা প্রত্যাশা করছেন।

লন্ডনে বৈঠক থেকে ডাক : এদিকে লন্ডনে গতকাল বুধবার কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনের ফাঁকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাজ্য ও কানাডা আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ সংকট মোকাবেলায় কার্যকর বৈশ্বিক ভূমিকার ডাক দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ছাড়াও ওই বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ভোলা যাবে না। কমনওয়েলথ সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের বাংলাদেশে জরুরি এই মানবিক সংকটের জোরালো সাড়া প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।’

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গা থেকে আমাদের মনোযোগ যাতে অন্যত্র সরে না যায় তা নিশ্চিত করতে কমনওয়েলথ সম্মেলনকে কাজে লাগানো হবে। মিয়ানমারকে প্রমাণ করতে হবে যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। নৃশংসতার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্তই হবে এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেন, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এ সংকট সমাধানে দুর্গতদের পাশে থাকতে হবে। সহিংসতার হোতাদের বিচারের আওতায় আনা এবং মিয়ানমারে সামাজিক সম্প্রীতি ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

বৈঠকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদলের আসন্ন সফর, নৃশংসতার স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসন বিভাগ এবং ইউএসএআইডিয়ের মাধ্যমে কক্সবাজার, ভাসানচর এ অঞ্চলের ...

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিসহ তিনটি শর্ত হামাসের

মিশর ও কাতারের মধ্যস্থত গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস তিনটি ধাপ অন্তর্ভুক্ত করতে ...